ফরিদপুর প্রতিনিধিঃ
বাংলাদেশে পুরুষরা ক্রমশ একটি নীরব নির্যাতনের শিকার হয়ে উঠছে। এটি এমন একটি বাস্তবতা যা এখনো সমাজে স্বীকৃতি পায়নি, বা আলোচনার মূলধারায় উঠে আসেনি। পরিবার, সম্পর্ক ও সামাজিক পরিবেশে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে যেমন প্রবল প্রতিরোধ ও আইনগত ব্যবস্থা রয়েছে, তেমনি পুরুষদের ওপর ঘটে যাওয়া নির্যাতনের ঘটনা থেকে আমরা অনেকটাই উদাসীন।
সম্প্রতি বিভিন্ন সংগঠন ও গবেষণার মাধ্যমে উঠে এসেছে—বাংলাদেশে পুরুষরাও বিভিন্নভাবে নির্যাতিত হচ্ছেন। সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার পর মিথ্যা ধর্ষণের অভিযোগ, যৌতুক মামলা, সন্তান দেখা থেকে বিরত রাখা, মানসিক চাপে আত্মহত্যার ঘটনা—সবই পুরুষ নির্যাতনের বহুমুখী রূপ।
এক জরিপ অনুযায়ী, দেশে পুরুষ নির্যাতনের হার ৪৫% এবং নারী নির্যাতনের হার ৪০%। অথচ প্রচলিত ধারণা বলছে—শুধুমাত্র নারীরাই নির্যাতনের শিকার হন। গণমাধ্যম, আইন-আদালত এবং সমাজব্যবস্থা এখনো সেই একমুখী দৃষ্টিভঙ্গিকেই গুরুত্ব দেয়।
এক তরুণ জানান, “প্রেমিকাকে সম্পর্ক শেষ করার কথা বলার পর সে মিথ্যা ধর্ষণ মামলা দায়ের করে। আদালতে দীর্ঘ লড়াই করতে হয়েছে, যা আমার সামাজিক মর্যাদা ও মানসিক স্থিতি দুটোই ধ্বংস করেছে।”
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নির্যাতন কোনো লিঙ্গভিত্তিক সমস্যা নয়। এটি একটি মানবিক সমস্যা। পারিবারিক সহিংসতা, মানসিক অত্যাচার, সামাজিক বঞ্চনা—সবই নির্যাতনের অন্তর্গত। পুরুষরা শারীরিকভাবে নারীর তুলনায় শক্তিশালী হলেও মানসিকভাবে প্রতিনিয়ত ভেঙে পড়ছেন এই সামাজিক ও আইনি বঞ্চনার কারণে।
মানবাধিকার কর্মী তাসনিম হোসেন বলেন, “আইনের অপব্যবহার ঠেকানো যেমন জরুরি, তেমনি সত্যিকারের ভুক্তভোগীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করাও জরুরি। লিঙ্গ নয়, অপরাধের ভিত্তিতে বিচার হওয়া উচিত।”
বিভিন্ন মামলার পর্যালোচনায় দেখা গেছে, অনেক পুরুষ স্ত্রীর নির্যাতনের শিকার হলেও চক্ষুলজ্জা, সন্তানের ভবিষ্যৎ ও মামলার ভয়েই মুখ বন্ধ রাখেন। অনেক সময় দেখা যায়, স্ত্রী স্বামীকে শারীরিকভাবে আঘাত করেছেন, মানসিক চাপ দিয়েছেন, কিংবা পরিবারের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছেন—যা একপ্রকার ‘ঘরের ভেতরের নির্যাতন’।
সাম্প্রতিক একটি ব্রিটিশ গবেষণায় উঠে এসেছে, পারিবারিক নির্যাতনের ৪০% শিকার হচ্ছেন পুরুষরা। ব্রিটেনে প্রতি পাঁচটি ঘটনার মধ্যে দুটি ঘটেছে পুরুষদের সঙ্গে। ‘প্যারিটি’ নামের একটি সংস্থার মতে, বিশ্বজুড়ে পুরুষ নির্যাতনের হার উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে। তবে পুলিশ, প্রশাসন বা মিডিয়া এদের কণ্ঠস্বরকে সেভাবে গুরুত্ব দেয় না।
বাংলাদেশে এখনো পুরুষ নির্যাতনের কোনো সরকারি পরিসংখ্যান নেই। কিছু বেসরকারি সংস্থা চেষ্টা করলেও তাদের তথ্য সংগ্রহের সুযোগ সীমিত। ফলে নির্যাতিত পুরুষদের জন্য আইনি বা সামাজিক সুরক্ষা কাঠামো গড়ে ওঠেনি। অনেক ক্ষেত্রেই নারী নির্যাতনের আইনগুলো উল্টোভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে পুরুষদের বিরুদ্ধে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, সমাজে পুরুষদের “সহ্যশীল”, “মজবুত” বা “অভিমন্যু” হিসেবে গড়ে তোলার চাপ তাদের বাস্তব অভিজ্ঞতা প্রকাশে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। ছেলেরা কাঁদে না—এই সংস্কার তাদের যন্ত্রণাকে আরও গভীর করে।
সত্যিকার অর্থে সমাজে সমানাধিকার মানে কেবল নারীর ক্ষমতায়ন নয়, বরং পুরুষের কণ্ঠও শোনা। রাষ্ট্রের উচিত—একটি নিরপেক্ষ তদন্ত ব্যবস্থা গড়ে তোলা, যেখানে উভয় পক্ষের বক্তব্য গুরুত্ব পাবে। যাতে কোনো নিরীহ ব্যক্তি মিথ্যা মামলার শিকার না হন, এবং কোনো অপরাধীও আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে যেতে না পারেন।